আমনের ভরা মৌসুম চলছে। তবুও সব ধরনের চালের দাম বেড়েই চলছে। ইতোমধ্যে ৫০ হাজার টন চাল চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছেছে। জানুয়ারির মধ্যে আসছে আরো দেড় লাখ টন। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে তাহলে কী দেশে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমান আরা খানুম নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘চালের দাম কেন এই ভরা মৌসুমে বাড়ছে, এটা আমরাও ভাবছি। আমাদের ধারণা, এবার কৃষক ধানটা একটু অল্প অল্প করে ছাড়ছে।’
চালের কোনো সঙ্কট নেই জানিয়ে খাদ্যসচিব বলেন, সবার ঘরে ঘরে ধান-চাল আছে। আমরা মোটা চাল আমদানি করছি, যাতে নিম্নআয়ের লোকদের কষ্ট না হয়।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) গত আগস্ট মাসে আভাস দিয়েছিল এ বছরের শেষে প্রায় সাড়ে ৫৫ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। তখন বলা হয়েছিল, নভেম্বরের মধ্যে আউশ ও আমনের উৎপাদন যুক্ত হলে খাদ্য ঘাটতির কোনো আশঙ্কাই থাকবে না। কিন্তু গত ২১ ডিসেম্বর সংস্থাটি জানিয়েছে, আগামী জুন নাগাদ ৩০ লাখ টন ঘাটতি থাকবে। অর্থাৎ উৎপাদন কম হয়েছে। কী কারণে উৎপাদন কম হয়েছে, তা জানতে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় ব্রির মহাপরিচালক ড. মো: শাহজাহান কবীরকে ফোন দিলে তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে জানান।
এ ব্যাপারে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক পরিচালক বলেন, এ বছর আমনের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার থেকে ১০ শতাংশ কম উৎপাদন হয়েছে। ভরা মৌসুমে চালের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা বরাবরই ব্যবসায়ীদের কারসাজি। তারা গুদামজাত করে রাখেন বেশি মুনাফার আশায়। খাদ্য সঙ্কট না থাকলে কেন তাহলে সরকার আমদানি করছে- জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, মূলত সরকার কোনো রিস্ক নিতে চায় না। তাই আমদানির মাধ্যমে রিস্ক মুক্ত থাকতে চায়, যাতে কোনো কারণে খাদ্য সঙ্কটে পড়তে না হয়, অতিরিক্ত মজুদ রাখতে চায়।
সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বন্যাসহ নানা কারণে আমনের উৎপাদন ভালো না হওয়ায় ধানের দাম খুব বেশি। তিনি বলেন, এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমাদের চাল আমদানি করতে হবে। সেই সাথে আগামী বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন বাড়াতে হবে। অন্তত ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর উৎপাদন বাড়াতে হবে বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সরকারের মজুদ বাড়াতে চলতি মাসেই ভারত থেকে এক লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকারের ক্রয় কমিটি। সূত্রে আরো জানা যায়, প্রাথমিকভাবে দুই লাখ টন চাল আমদানি করা হবে। তবে পরিকল্পনা রয়েছে কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টন চাল আমদানির।
ব্যবসায়ীরা জানান, চলতি বছর পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে দেশে চার দফা বন্যায় আমন আবাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আমনের উৎপাদন হয়নি। এর প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে।
খাদ্য সচিব জানান, প্রথম চালানের ৫০ হাজার টন ইতোমধ্যেই চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছেছে। এ ছাড়া জানুয়ারির মধ্যে আরো অন্তত দেড় লাখ টন চাল আসবে।
ভরা মৌসুমে চালের দামের ঊর্ধ্বগতি প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তকে খাদ্য সচিব বলেন, ‘আমরাও সেটা ভাবছি, চালের দাম কেন এই ভরা মৌসুমে বাড়ছে। আমাদের ধারণা, এবার কৃষক ধানটা একটু অল্প অল্প করে ছাড়ছে। শুধু চালের দাম বাড়েনি…, গত বছর যখন দেখেছি ৬০০ টাকা মণ ধানের মূল্য, সে সময় চালের দামে অসামঞ্জস্য ছিল। কিন্তু এবার কৃষকও ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে, চালের মূল্যও বাড়ছে। কিন্তু এটা আমাদের ভোক্তাদের জন্য আবার কাঙ্ক্ষিত না। সে কারণে আমরা চেষ্টা করছি, আমদানি করে বাজারটাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে। এ ছাড়া বিতরণ ব্যবস্থাও জোরদার করব। এই দুটো বিষয়ে আমরা কাজ করছি। আমাদের উৎপাদন যথেষ্ট হয়েছে, আপনারাও দেখেছেন মাঠভর্তি ফসল। যদিও আমফান ও বন্যা ছিল। কিন্তু আমাদের ওই রকম ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতি হয় নাই এবং বর্তমানে জনসংখ্যার যে হিসাব, সেটা অনুযায়ী আমাদের চাল উদ্বৃত্তই থাকার কথা। ধান চাল উদ্বৃত্ত থাকলে, সেটা কিন্তু বাজারে আসবেই। নিজেও বোঝেন যে, চালটা (বেশি দিন রাখলে) নষ্ট হয়ে যায়। ধানও একটা নির্দিষ্ট সময় পর রাখা যায় না। সেটা যদি লাভজনক না হয়, পোকা খায় তাহলে কৃষক কিন্তু রাখবে না। এ জন্য আমার ধারণা, হয়তো বা আমাদের জনসংখ্যার যে হিসাব করেছি, এতজন মানুষ এতটুকু খায়, এটার কিছুটা হয়তো কমবেশি হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘বিদেশ থেকে মানুষ আসছে। এ ছাড়া করোনার লকডাউনের সময় অনেকে কর্মহীন হয়ে গেছে, ব্যবসা-বাণিজ্য হারিয়েছে। তারা হয়তো ধান চাল রেখে ব্যবসা করছে, রাখি বিজিনেস। এসব বিভিন্ন কারণে হয়তো হাতে হাতে চলে গেছে। আমি আরেকটা কাজ করেছি সেটা হলো, আগে মিলাররা ১৫ দিনের যে খাদ্য দরকার তা ৫ গুণ হারে ৩০ দিন রাখতে পারত। এটা বন্ধ করে দিয়েছি। এখন ৩ গুণ করা হয়েছে। ৩০ দিন পর ছাড়বে, আবার কিনবে এভাবে চলবে। মিলাররা একবারে সারা বছরেরটা মজুদ করে রাখতে পারবে না। এখন মিলাররা যদি বছরেরটা একেবারে কিনে রাখে এটা অন্যায়। সেটার জন্য মাঠ প্রশাসন ও খাদ্য অধিদফতর মনিটরিং জোরদার করেছে। যদি কেউ অবৈধ মজুদ রাখে সেটা বের হবে এবং আইনানুগ শাস্তি পাবে। আরেকটা হলো অনেক উৎপাদন হয়েছে, কৃষক সংরক্ষণ করে রেখেছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারছে না, এখন রাখি মালের (ধান-চাল স্টক) ব্যবসা করছে। আড়তদাররা মজুদ রাখছে। ২২ হাজার মিলার মজুদ রাখছে। ফলে বাজারে যে সরবরাহ সেটা একটু কমে গেছে।’
ধানের দাম বেড়েছে, এটা কৃষকের জন্য ভালো উল্লেখ করে খাদ্য সচিব বলেন, ‘আমরা কৃষককে ন্যায্যমূল্য দিতে চাই। আর সেটা পাচ্ছে। আমাদের ভোক্তাদের কথা চিন্তা করতে হবে, সেটা আমদানির মাধ্যমে ওএমএসসহ অন্যান্য কার্যক্রম জোরদার করে বাজারটা নিয়ন্ত্রণে আনব। তবে এটা সত্যিকথা ধানের দাম যখন কমে যায় তখন আপনারাই বলেন, কৃষক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। এখন কিন্তু পাচ্ছে। এতদিন কিন্তু পায়নি।’
তিনি বলেন, ধান-চালের কোনো সঙ্কট নেই। সবার ঘরে ঘরে ধান-চাল আছে। যদি এ রকম হতো বাজারে পেতেন না। মিলে যান, ব্যবসায়ীর আড়তে, কৃষকের ঘরে যান, সব জায়গায় আছে। তাহলে আমদানিটা কেন? জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘আমরা আমদানি করছি, আপনাদের কষ্ট লাঘব করার জন্য। আমাদের যারা গার্মেন্ট শ্রমিক আছে, রিকশাচালক আছে, তাদের যাতে বেশি দামে চাল না কিনতে হয় সে জন্য। কারণ হলো মোটা চালের সরবরাহ একটু কমে গেছে। মোটার আবাদ এখন আর তেমন হয় না। সবাই চিকনের দিকে ঝুঁকছে। সে জন্য আমরা মোটা চাল আমদানি করছি যাতে নিম্নআয়ের লোকদের কষ্ট না হয়। কারণ শুধু কৃষককে ন্যায্যমূল্য দেবেন, তারা তো সরকারের প্রণোদনা পাচ্ছেই। কিন্তু রিকশাচালক, গার্মেন্ট শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিকসহ নিম্নআয়ের মানুষ সবাই তো চাল কিনে খাচ্ছে। তাদের জন্য সরকারকে ভাবতে হয়।’
Leave a Reply